ঢাকা৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সুখ-অসুখ

প্রতিবেদক
admin
এপ্রিল ১১, ২০২৪ ১০:৪৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সুখ অসুখ
লেখক গোলাম মওলা সিরাজ

বাবুই পাখির মতো খড়কুুটো জড়ো করে নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছিল ভুবন। ছনখড়ে আকাশ ঢাকা। পাটখড়ি আর কাঁশ মিলে চারপাশের আচ্ছাদন। পেটে অশান্তি থাকলেও ঘরটাতে শুয়ে শান্তির ঢেকুর তুলতো। আয়েশের ভালোবাসায় মাঝে মধ্যে চোখে জল ঝড়তো। কতজনের বাড়িতে রাত কাটানোর অনুরোধ করে অপমানে শির কেটে রাস্তায় রাত কেটেছে তার। সেসব তার কাছে ভয়ানক স্মৃতি।

যেবার চরের কৃষকের জাগ দেয়া পাটের আঁশ ছাড়িয়ে বেশ কিছু পাটখড়ি জমে। সেবারই তার আশা জাগে মনে। বাঁশ ঝাঁড়ের ভেতর একটা ঘর করবে সে।জমিওলা না বলবেনা; মনে হয়। তারপর রোদে পুড়ে পুড়ে ছনখড় সংগ্রহ। নিজে নিজে শান্তির আস্তানা দাঁড় করিয়ে নিজেকে মহারাজ আবিষ্কার করে ভুবন। রাত্রিবেলার বাঁশের উড়ন্ত কঞ্চির সাথে পথভোলা একাকি বাতাসের ঝাপটানো আর পোকা মাকড়ের উৎপাৎ তাকে বিরক্ত করছিল। তবে ভাবনায় নুয়ে পড়া চোখ ঘুমে ভুলিয়ে দিতো সব। চার বছর ওই ঘরে সুখে ছিল ভুবন।

মাসখানেক আগে হঠাৎই ভুবনের ঘরে পা রাখে দামি শার্ট কোট পড়া বাবু। বাবুর চকচকা শরীর। বেশ নাম ডাক এখন। গত ভোটে যখন এলাকার জনপ্রতিনিধির নামটা পাল্টে গেল। তারপর থেকে বাবুর চোখে উঠলো কালো চশমা। প্যান্ট, শার্ট ভাঁজ খুলে পড়া শুরু করে সে। কারণ সেও নেতা।
বাবুকে ঘরে দেখে বিড়ির শেষ অংশটা চকির নিচে ফেলে দেয় ভুবন। মুখের ধোঁয়াটা আড়াল করার চেষ্টা করে। ততক্ষণে হেসে দিয়ে বাবু সরম ভেঙে বলে ‘কি, শান্তির বিড়ি খাচ্ছো দেহি। ভালোই আছো তো।’
খুব দ্রুত জবাব দিতে পারে না ভুবন। নিজেকে আউলা মনে করে। ‘আছি দাদা বলে মুচকি হাসি দেখায়। বিছানায় বসে বাবু।
কয়েক মিনিটে কথা শেষ করে বেরিয়ে যায় বাবু। বালিশের নিচের প্যাকেট থেকে আর একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দেয় ভুবন। তখন তার দু পা নাচছিল। বাবুর মতো গাও গতরে একটা ভাব দেখতে পায় নিজে।
পরের দিন সকালে বিছানার কমদামি চাদরটাতে মোড়ানো একটা পোটলা মাথায় নিয়ে সামনের মোড়ের কাছে রাস্তার উপর করা হাফ বিল্ডিংটাতে ঢোকে ভুবন। পাশের পানের দোকানদার দেখতে পেয়ে হাঁক দেয়। ‘ কি ভুবন বিল্ডিং এ থাকবু নাকি?’ ‘হ’রে বাবু দাদা কইলো’ বলে মাথার পোটলা নামায় ভুবন। ঘর কি করবি? দোকানীর প্রশ্নে ‘ভাংমু’ বলে সোজা উত্তর ভুবনের।
তারপর চকি, বিছানা। কয়েকদিন পর ঘর ভেঙে পাকা বাড়ির বাসিন্দা হয় ভুবন। ইটের ঘরের বেড়ার জোরের মতো মনের জোর বাড়ে। চালচলন বদলে।
এখন অনেকে পাকা ঘরে গল্প করতে আসে। গল্পে গল্পে পুরাতন ঘরের ছন, পাটখড়ি চুলায় ঢোকায় ভুবন। ছয়মাস তার রান্নার খড়ির অভাব হয়নি। আরও কয়েকদিন চলবে। এখনও কয়েটা বাঁশ তাজা আছে। বাঁশের আগুনে রান্না তারাতাড়ি হবে ভাবতেও ভালো লাগে তার।
একদিন সকালে হঠাৎ করে কোট টাই পড়া স্যারসহ কয়েকজন লোক আসে ভুবন যে ঘরে থাকে তার কাছে। আশপাশের লোকজন জড়ো হয়। কেউ একজন মোবাইলে কল করে বাবুকে জানায়। বেচারা ভুবন সেদিন অনেক দূরে গেছে।
খানিক পড়ে গড় গড় করে আসে লম্বা চাকার বুলডোজার। হরমর শব্দে ঘরটা ভূপাতিত করে দেয় মুহুর্তে। দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে বাবু। মোবাইল ফোনে কারও সাথে যোগাযোগ করতে দেখা যায়। মুখে নিরাশার ছায়া।
শেষে ঘরটির চারদিকে লাল নিশান টানিয়ে কাজ শেষ করে অফিসের লোক। বড় স্যার ছাপ ছাপ জানিয়ে দেয়, ‘এটা সরকারি জায়গা দখল করা হয়েছে। এরপর এখানে ঘর ওঠানোর চেষ্টা করা হলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে’। স্যারের কথা কানে যায়না বাবুর। কিন্তু কর্তা কি বলবেন তা তার জানা। ভোটের পরে সরকারি জমিটা দখল করে ঘর করেছে।
সেদিন দিনের আলো দ্রুত ছুটি নেয় ভুবনের কাছে। বিড়ির আগুন আলো না দিলেও হাটার গতি বাড়ায় তার। মোড়ে এসে খেই হারিয়ে ফেলে। গাভেজা আঁধারে চারদিকে তাকায়। ঠাওর করতে পারেনা কি ঘটেছে। বিড়ির আলোর সাথে রাত কাটে ভুবনের।
সকালে তার ভেতরটা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বাবুর বাড়ির অতোটুকু পথে শত মাইল হেঁটে বাবুকে না পেয়ে হাঁটতে থাকে চরের দিকে।